Saturday, 26 November 2016

চাষযোগ্য কয়েকটি মাছের খাদ্যাভ্যাস ও স্বভাব

মাছের স্বভাব-কথা


মানুষ শৌখিনতার গণ্ডি ছেড়ে এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নিজের পুকুরে, বিলে বা ছোট জলাশয়ে মাছের চাষ করতে শিখেছে। তারা জেনেছে একক মাছ চাষের চেয়ে মিশ্র মাছ চাষে অধিক লাভ হয়। জলে মাছের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ সুষ্ঠু ভাবে কাজে লাগানো যায় এই মিশ্র মাছ চাষে। সব প্রাণী ও উদ্ভিদের মতো মাছেরও জাতি-প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের চাহিদা থাকে। তাদের খাদ্যাভ্যাস ও বসবাসের ধরনধারণও আলাদা হয়। এই বিভিন্নতাকে কাজে লাগাতে পারলে প্রকৃতির দান আমরা শুধু বিতরণে এবং ফলন বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে পারি। আমাদের ছোট ও প্রান্তিক মাছচাষি এমনকী বড় মাছচাষিরাও তাঁদের জলাশয়কে পালন-পুকুর বা মজুত-পুকুর হিসাবে কাজে লাগান — অর্থাৎ বাজার থেকে ধানি পোনা বা আঙুলে পোনা কিনে পুকুরে ছাড়েন, তাদের লালনপালন করে পরে বড় হলে প্রয়োজনমতো বিক্রি করেন।
বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত প্রজননের সুযোগ হয়েছে। মাছচাষি যাঁরা ডিম ও ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা তৈরি করেন, তাঁরা নিশ্চিত ভাবে জানেন সেই ডিম, ধানি পোনা বা আঙুলে পোনা কোন জাতের এবং কোনও রকম ভাবে মিশ্রণ ছাড়াই মাছ-পালক চাষি তাঁদের পছন্দমতো জাতি-প্রজাতির মাছ এবং প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সংখ্যক মাছ কিনে তাঁদের জলাশয়ে ছাড়তে পারেন। পরিমাপ ও পরিবেশের নিরিখে পুকুরে নির্দিষ্ট সংখ্যক পছন্দের মাছ ছাড়া চাষিদের পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে। অধিকাংশ চাষি তাদের পালন ও মজুত-পুকুরে নিজেদের সঙ্গতি ও বাজারের চাহিদার কথা ভেবে রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প ও আমেরিকান রুই-এর চাষ করেন। সংক্ষেপে তাদের স্বভাব ও খাদ্যাভ্যাস বণর্না করা হল।

সিলভার কার্প

এদের আদি নিবাস চিন দেশে ও রাশিয়ার আমুর নদীতে। দেহ রুপোলি বর্ণের ছোট ছোট আঁশে ঢাকা। দেহ লম্বা ও চ্যাপ্টা, মাথার সামনের ভাগ সরু ও নীচের চোয়াল সামান্য প্রসারিত। চোখ সাধারণত ছোট। মাথার পরের অংশ থেকে শুরু করে জননছিদ্র পর্যন্ত অঙ্গদেশ খাঁজকাটা। কাতলা মাছের মতো এরাও পুকুরের উপরের স্তরে থাকে, ফলে খাদ্য সংগ্রহের জন্য কাতলা মাছের সঙ্গে এদের সামান্য প্রতিযোগিতা আছে। ছোট অবস্থায় এরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্যাওলা খায়। বড় হলে উদ্ভিদকণা এদের প্রধান খাদ্য। এ ছাড়া পচা জলজ উদ্ভিদের অংশও খায়। এদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এদের ফুলকায় রেকারের সংখ্যা অনেক হওয়ায় এরা অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা খেতে পারে যা অন্য মাছে খেতে পারে না। এর ফলে পুকুরে এদের প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব হয় না এবং তাড়াতাড়ি বাড়ে। মোটামুটি দু’ বছরেই এরা প্রজননে সক্ষম হয়ে ওঠে। ৩ – ৮ কেজি ওজনের সিলভার কার্পের ডিম্বাশয়ে ডিমের সংখ্যা ১.৪৫ – ২.০ লক্ষ। এক বছরেই এরা ১.৫ কেজি ওজনের হয়। এরা পুকুরের বদ্ধ জলাশয়ে ডিম ছাড়ে না। তবে প্রণোদিত প্রজনন প্রক্রিয়ায় ডিম পাড়ে। এরা ভীষণ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় কিন্তু বাজারে অন্যদের থেকে দাম একটু কম।

গ্রাস কার্প

গ্রাস কার্প বা ঘেসো রুই মাছের আদি বাসস্থান চিন দেশের নানা নদ-নদী ও রাশিয়াতে অবস্থিত আমূর নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং, ইজরায়েল, শ্রীলঙ্কা, ভারত প্রভৃতি দেশে চাষ হচ্ছে। ভারতে ১৯৫৯ সালে হংকং থেকে গ্রাস কার্প এনে পরীক্ষামূলক ভাবে চাষ করা হয়। ঘেসো রুই দেখতে মৃগেল মাছের মতো। লম্বাটে দেহ তবে চওড়ায় বেশি নয়। মুখ ছোট এবং উপরের ঠোঁট নীচের তুলনায় একটু লম্বাটে। পিঠটা ধূসর বর্ণের, কিন্তু পেটের রং রুপোলি বর্ণের। এরা পুকুরের মাঝের স্তরে থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্যাওলা খায়। বড় হলে ঝাঁঝি গুড়িপানা, ঘাস, শ্যাওলা প্রভৃতি জলজ উদ্ভিদ এদের প্রধান খাদ্য। পুকুরে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই মাছ বিশেষত উপকারী। এরা নিজেদের দেহের ওজনের দ্বিগুণ খাদ্য গ্রহণ করে। ভারতের জলবায়ুতে পুরুষরা দ্বিতীয় বছরেই জনন ক্রিয়ার উপযুক্ত হয়। ওই সময় জননঅঙ্গ থেকে শুক্রাণু বের হয়, কিন্তু স্ত্রী মাছের তৃতীয় বছর জননঅঙ্গ পরিপক্ক হয়। ৪ – ৭ কেজি ওজনের মাছের ডিম্বাশয়ে ডিমের সংখ্যা ৩ লক্ষ থেকে ৬.২ লক্ষ হয়। মিশ্র চাষে এই মাছ এক বছরে ১.৫ কোজি ওজনের হয়। এরা শাকাহারি। এরা প্রচুর খায় এবং ভীষণ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়। দেখতে মৃগেলের মতো। অনেকে মহাশোল বলে ভুল করে। বাজারে রুই-কাতলার চেয়ে দাম কম।

আমেরিকান রুই বা সাইপ্রিনাস কার্প

আমেরিকান রুই বা সাইপ্রিনাস কার্পের আদি নিবাস এশিয়া মহাদেশের উষ্ণ অঞ্চল, চিন, কৃষ্ণসাগর, ক্যাসপিয়ান সাগর ইত্যাদি অঞ্চলে। তবে বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্রই এই মাছ একক বা অন্যান্য মাছের সঙ্গে চাষ করা হয়। এরা পুকুরের তলদেশে থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা খায়। বড় হলে শ্যাওলা, উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, পচা জলজ উদ্ভিদ, কেঁচো, গুগলি ও কাদামাটি প্রভৃতি খায়। এক কথায় এরা সর্বভুক। এই মাছের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল খাদ্য সংগ্রহের সময় পুকুরের তলদেশে গর্ত করে; এর ফলে জলজ উদ্ভিদের মূল আলগা হয়ে যায় এবং এই ভাবে পুকুরের জলজ উদ্ভিদকে নিয়ন্ত্রিত করে। এদের বৃদ্ধি খুব ভালো। কিন্তু এদের পেটে প্রচুর চর্বি এবং ডিম হওয়ার কারণে এবং স্বাদ, দাম অপেক্ষাকৃত একটু কম। ছোট মাছের চেয়ে বড় মাছের দাম বেশি।



সিলভার কার্প

সিলভার কার্প

সিলভার কার্প

সিলভার কার্প

সিলভার কার্প

চাষযোগ্য মাছেদের খাদ্য সংগ্রহের বিভিন্ন স্তর

সব মাছের যেমন একই রকম খাদ্য পছন্দ নয় তেমনই সব মাছই জলের একই স্তরে থাকে না। বহুল প্রচলিত চাষযোগ্য মাছগুলি জলের বিভিন্ন স্তরে থাকে এবং সেই অনুযায়ী খাবার সংগ্রহ করে।
আমরা আমাদের পুকুর, দিঘি, বিলে যখন সুনির্দিষ্ট মাছের চাষ করি তখন বাজারের কথা ভেবে এবং নিজের লাভের দিকে নজর রেখে সাধারণত রুই, কাতলা, মৃগেল, সাইপ্রিনাস কার্প, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মাগুর, শিঙি, কৈ, বাটা ইত্যাদি মাছের চাষ করে থাকি। জলাশয়ের জল, খাবার, জলস্থিত অন্যান্য মাছের প্রয়োজনীয় উপাদানের সুষ্ঠু বিবর্তনের জন্য মাছেদের এই অভ্যাস সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা প্রয়োজন। নদ-নদী, খাল, বিল, দিঘি, পুকুরের জলের তিনটি স্তর কল্পনা করা যেতে পারে।
  • (১) উপরি স্তর : জলের সব থেকে উপরের স্তর, যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে ফলে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটন তাদের ক্লোরোফিলের সাহায্যে খাবার সংগ্রহ করে ও বংশ বিস্তার করে। এই স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণও বেশি। এখানে জলস্রোত বিদ্যমান। এ সব কাতলা মাছের খুব প্রয়োজন ও পছন্দের। কাতলা মাছ মুখ্যত এই স্তরেই থাকে। সিলভার কার্পও এই স্তরের বাসিন্দা।
  • (২) মধ্যস্তর : এখানে জলস্রোত ও জল-তরঙ্গ অপেক্ষাকৃত কম। মাছের জন্য জুপ্ল্যাঙ্কটন, প্ল্যাঙ্কটন ও অক্সিজেন উপযুক্ত পরিমাণে থাকে। এই স্তরের বাসিন্দা রুই মাছ, গ্রাস কার্প, বাটা মাছ ইত্যাদি।
  • (৩) নিম্নস্তর : জলাশয়ের নিম্ন স্তরে প্ল্যাঙ্কটনের চেয়ে জুপ্ল্যাঙ্কটনই বেশি থাকে। জলজ ক্ষুদ্র প্রাণীও বেশি থাকে এই স্তরে। এখানে জলের স্রোত প্রায় নিস্তেজ। এখানে পাঁকমাটি যথেষ্ট থাকে। এই স্তরে মৃগেল, শিঙি, মাগুর, কৈ, ল্যাটা, শোল, শাল ইত্যাদি মাছের বসবাস।

খাদ্যের ভিত্তিতে চাষযোগ্য মাছের শ্রেণি বিভাগ

শাকাহারি থেকে সর্বভুক


অন্তর্দেশীয় জলাশয়গুলির জলকেই আমরা মিঠে জল বলে থাকি। ছোট অ্যাকুরিয়াম থেকে শুরু করে আঁতুড় পুকুর, খাল, বিল, নদ, নদী -- সবই মিঠে জলের আধার। তাই এই জলের জলাশয়গুলির রীতিমতো বৈচিত্র্য, ততোধিক বৈচিত্র্যময় মাছের প্রকারভেদ। আকৃতি-প্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, রঙ-ঢঙ, স্বাদে-গন্ধে তাদের বৈচিত্র্য সীমাহীন। তাদের চাষের পদ্ধতিও ভিন্ন। আমরা মিঠে জলেই মাছ চাষ করে থাকি। এখানে আমাদের পছন্দমতো মাছ উপযুক্ত জলাধারে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চাষ করতে পারি। তাই মাছের প্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকা দরকার।
খাদ্যের প্রকারের উপর ভিত্তি করে মাছকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
  • (১) শাকাহারি : এই শ্রেণির মাছেরা জলের ছোট ছোট উদ্ভিদ, উদ্ভিদকণা, পচাগলা অংশ অথবা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন খেয়ে বেঁচে থাকে, বৃদ্ধি পায় ও বংশ বিস্তার করে। যেমন সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প।
  • (২) মাংসাশী : মূলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী (জুপ্ল্যাঙ্কটন) থেকে শুরু করে জীবের দেহাংশ বা পচাগলা প্রাণীদেহই এদের পছন্দের এবং প্রধান খাবার। শিঙি, মাগুর, কৈ, ল্যাটা, ফলুই ইত্যাদি এই দলভুক্ত।
  • (৩) রাক্ষুসে মাছ : এরা মাংসাশী। এরা বস্তুত মাংসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। জলজ প্রাণী, ছোট মাছ, মাছ-মাংসের টুকরো রাক্ষসের মতো খায়। এদের দৌরাত্মে পুকুরে বা জলাশয়ে অন্যান্য ছোট মাছের জীবন আশঙ্কিত ও অতিষ্ট হয়ে ওঠে। বোয়াল, চিতল, প্যাঙ্গাস, হাঙ্গর, তেলাপিয়া এই রাক্ষুসে মাছের উদাহরণ।
  • ৪) সর্বভুক : এই জাতীয় মাছ বস্তুত সব রকম খাবারই খায়। এদের নিজস্ব পছন্দের খাবার পোকামাকড় হলেও এরা প্রয়োজনে উদ্ভিদজ খাবার খেয়ে থাকে। আবার যারা মূলত উদ্ভিদভোজী প্রয়োজনে তারা পোকামাকড় বা জুপ্ল্যাঙ্কটন খেয়ে থাকে। অধিকাংশ মাছই তাদের ছোট অবস্থায় জুপ্ল্যাঙ্কটন খেতে পছন্দ করে। পরে প্ল্যাঙ্কটন বা অন্য খাবার খায়। যেমন কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি।

চাষযোগ্য মাছেদের খাদ্য সংগ্রহের বিভিন্ন স্তর

সব মাছের যেমন একই রকম খাদ্য পছন্দ নয় তেমনই সব মাছই জলের একই স্তরে থাকে না। বহুল প্রচলিত চাষযোগ্য মাছগুলি জলের বিভিন্ন স্তরে থাকে এবং সেই অনুযায়ী খাবার সংগ্রহ করে।
আমরা আমাদের পুকুর, দিঘি, বিলে যখন সুনির্দিষ্ট মাছের চাষ করি তখন বাজারের কথা ভেবে এবং নিজের লাভের দিকে নজর রেখে সাধারণত রুই, কাতলা, মৃগেল, সাইপ্রিনাস কার্প, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মাগুর, শিঙি, কৈ, বাটা ইত্যাদি মাছের চাষ করে থাকি। জলাশয়ের জল, খাবার, জলস্থিত অন্যান্য মাছের প্রয়োজনীয় উপাদানের সুষ্ঠু বিবর্তনের জন্য মাছেদের এই অভ্যাস সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা প্রয়োজন। নদ-নদী, খাল, বিল, দিঘি, পুকুরের জলের তিনটি স্তর কল্পনা করা যেতে পারে।
  • (১) উপরি স্তর : জলের সব থেকে উপরের স্তর, যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে ফলে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটন তাদের ক্লোরোফিলের সাহায্যে খাবার সংগ্রহ করে ও বংশ বিস্তার করে। এই স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণও বেশি। এখানে জলস্রোত বিদ্যমান। এ সব কাতলা মাছের খুব প্রয়োজন ও পছন্দের। কাতলা মাছ মুখ্যত এই স্তরেই থাকে। সিলভার কার্পও এই স্তরের বাসিন্দা।
  • (২) মধ্যস্তর : এখানে জলস্রোত ও জল-তরঙ্গ অপেক্ষাকৃত কম। মাছের জন্য জুপ্ল্যাঙ্কটন, প্ল্যাঙ্কটন ও অক্সিজেন উপযুক্ত পরিমাণে থাকে। এই স্তরের বাসিন্দা রুই মাছ, গ্রাস কার্প, বাটা মাছ ইত্যাদি।
  • (৩) নিম্নস্তর : জলাশয়ের নিম্ন স্তরে প্ল্যাঙ্কটনের চেয়ে জুপ্ল্যাঙ্কটনই বেশি থাকে। জলজ ক্ষুদ্র প্রাণীও বেশি থাকে এই স্তরে। এখানে জলের স্রোত প্রায় নিস্তেজ। এখানে পাঁকমাটি যথেষ্ট থাকে। এই স্তরে মৃগেল, শিঙি, মাগুর, কৈ, ল্যাটা, শোল, শাল ইত্যাদি মাছের বসবাস।

অন্তর্দেশীয় জলাশয়

মিঠে জল





যে মাছকে বেশির ভাগ মানুষ তাদের খাদ্য হিসাবে বা তাদের জীবন ও জীবিকা হিসাবে ব্যবহার করে তার প্রায় ৪০ শতাংশ মিঠে জলের মাছ বা অন্তর্দেশীয় জলাশয়ে উত্পন্ন হয়। মাছশিকারিরা জীবনের কম ঝুঁকি নিয়ে এই সব মাছ ধরতে পারে। এদের মধ্যে কিছু কিছু মাছ ধরা হয় প্রাকৃতিক বড় জলাশয় থেকে। আর বাকি শিকার হয় মানুষের তৈরি করা ছোট জলাশয় থেকে। এই অন্তর্দেশীয় জলাশয়গুলিকে কয়েকটি শ্রেণি এবং উপ-শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেমন —
মিঠে জলাশয়গুলি জমানো বৃষ্টির জল, মাটির নীচের জল বা পাহাড় থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে সমৃদ্ধ। এই জলের মাছের জাতি-প্রজাতি ও গতিপ্রকৃতি নোনা জলের মাছের থেকে আলাদা। এ ধরনের জলাশয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন —
  • (ক) নদী : এই জলাশয় প্রাকৃতিক। প্রাকৃতিক উপায়ে এটি বৃষ্টির জল বা পাহাড়ের বরফ গলা জলে পরিপূর্ণ থাকে। নদনদীর গতিপ্রকৃতিও প্রাকৃতিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত। মানুষ এখানে মাছ চাষ করে না। প্রাকৃতিক কারণেই এখানে মাছের ডিম পাড়া, ডিম ফোটা থেকে আরম্ভ করে তাদের জীবনচক্রের সবটাই এখানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। মানুষের চেষ্টা ছাড়াই। মানুষ নানা উপায়ে নানা প্রয়োজনে এই মাছ ধরে খায় ও জীবন ও জীবিকার নানা কাজে লাগায়। রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, শাল, বোয়াল থেকে শুরু করে কৈ, মাগুর, চিংড়ি, বেলে, মৌরলা, বাটা এমনকী ইলিশ, চাঁদা ইত্যাদি মাছ এই জল থেকে মানুষ পেয়ে থাকে। অন্য ছোট জলাশয়ে প্রতিপালনের জন্য সদ্যোজাত ডিম, ধানি পোনাও এই নদনদী থেকে মেলে। নদনদী নিয়ম করে সংস্কার ও দূষণমুক্ত রাখা আমাদের কর্তব্য।
  • (খ) খাল, বিল (ক্যানেল, লেক ইত্যাদি ) : মানুষ চাষবাসের মতো অন্য কাজের সঙ্গে মাছ চাষের জন্যও এইগুলো প্রাথমিক ভাবে খনন করে থাকে। মূলত, কৃষির খেতে জল সেচের ব্যবস্থার জন্যই এদের উত্পত্তি। বছরে বারো মাসেই এগুলয়য় জল থাকে। তাই এগুলোতে প্রাকৃতিক আশীর্বাদের মতোই নিয়মিত মাছ চাষ হয়ে থাকে। ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সমবায় গঠন করেই এগুলো বেশি কাজে লাগানো হয়। এগুলোতে নামি-দামী মাছের সঙ্গে অনামি মাছও প্রচুর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হয়ে থাকে। এগুলো নিয়মিত ভাবে সংস্কার করা না হলেও মোটামুটি ভাবে পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত থাকে। এখানে রুই, কাতলা, মৃগেল থেকে মিষ্টি জলের সব মাছই চাষ হয়ে থাকে।
  • (গ) দিঘি-পুকুর-ডোবা: এগুলো ব্যক্তি-মালিকানাভিত্তিক। এগুলো মুখ্যত তৈরিই করা হয় গ্রাম সংলগ্ন অঞ্চলে মাছ চাষের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও সাংসারিক ছোটখাটো নানা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। এই সব জলাশয়ে নিজেদের খাওয়ার সঙ্গে ছোট বড় ব্যবসা করার জন্য অনিয়মিত বা বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছ চাষ করে হয়ে থাকে। এখানে মুখ্যত মাছ পালনই করা হয়।
  • এ ধরনের জলাশয়ের আবার নানা ভাগ থাকতে পারে --- প্রজনন (ব্রিডিং) পুকুর, ডিম ফোটানোর (হ্যাচারি) পুকুর, আঁতুড় (নার্সারি) পুকুর ও প্রতিপালন (রিয়ারিং) পুকুর। এগুলো বিশেষ যত্ন নিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি ও ব্যবহার করা হয়। এগুলো আকৃতিতে ছোট হয়। নিজেদের পছন্দের মাছের প্রজনন, তার থেকে ডিম সংগ্রহ, ডিম ফোটানো, ধানি পোনা ও ছোট পোনা এবং মাছ প্রতিপালনের জন্য তৈরি করা হয় এবং এই সব কাজের জন্য এখানে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এখানে সাধারণত ব্যবসাভিত্তিক এবং নামি-দামী মাছের পোনা উত্পন্ন করা হয়।
  • (ঘ) রঙিন মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম : এইগুলো কাচের ছোট বড় বাক্সের আকৃতির জলাশয়। নানা রকম, নানা ঢঙ, নানা কাঠামোর হয়ে থাকে এগুলো। এর ভিতরে রঙিন মাছ রাখা হয়। বাড়ির শোভা বৃদ্ধি বা কোনও স্থানকে বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য এগুলো স্থাপন করা হয় এবং এর ভিতর দৃষ্টিনন্দন নানা মাছ রেখে দেওয়া হয়।


সমুদ্র অঞ্চলে সমুদ্রের নোনা জল ও বৃষ্টির জল মিশে থাকে এই জলাশয়গুলোতে। এখানে নোনা জলের মাছই মুখ্যত থাকে কিন্তু সেখানে গভীর সমুদ্রের মাছ, খুব বড় মাছ বা অতি নোনা জলের মাছ থাকে না। সাধারণত দু’ রকমের অর্ধ নোনা জলাশয় দেখা যায় ---
  • (ক) খাড়ি : এগুলি সমুদ্র তীরবর্তী প্রাকৃতিক সৃষ্টি। সমুদ্রের কাছে নিচু জায়গা জোয়ারে প্লাবিত হয়। পরবর্তী কালে জোয়ারের জল সেখানে আবদ্ধ হয়ে একটা বিস্তীর্ণ জলাশয় সৃষ্টি করে। প্লাবন কালে যে সব মাছ জলের সঙ্গে আসে মুখ্যত সেগুলি শিকার করা হয়। সেখানে আলাদা করে কোনও মাছ চাষ করা হয় না।
  • (খ) ভেড়ি : সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকায় লবণাক্ত মাটিতে উপযুক্ত ফসল ফলানো কঠিন। অনেক সময় মানুষ সেই সব অঞ্চলে বড় বড় পুকুরের মতো জলাশয় তৈরি করে মাছ চাষ করে। এগুলো মাছ চাষের জ্ন্যই মুখ্যত তৈরি হয় এবং এখানে ব্যবসাভিত্তিক মাছ চাষ হয়ে থাকে। এগুলো বৃষ্টির জলে সমৃদ্ধ থাকে — প্রয়োজনে পাম্পের সাহায্যে জল দেওয়া হয়। এখানে ভেটকি, তেলাপিয়া, চিংড়ি চাষ লাভজনক। সমুদ্র থেকে বেশ দূরে নিচু ধানজমিকে অনেকে ভেড়িতে পরিণত করে মাছ চাষ করছে। সেখানে রুই, কাতলা, কৈ, মাগুরের চাষ করেও বেশ লাভ করা যায়। এখানে শুধু মাছ প্রতিপালন করা হয়। ভেড়িতে প্রজনন বা ডিম ফোটার কোনও ব্যবস্থা থাকে না। এ ছাড়াও ধান জমিতে মাছের চাষ হয়। নিচু জমিতে ধান চাষের সঙ্গে সঙ্গে চলে মাছের চাষ। নিচু জমিতে ধানের মধ্যে জল অনেক দিন থাকে। এই সময় এতে জিওল মাছের চাষ খুব ভালো হয়। ধানি পোনা থেকে চারা পোনা তৈরিতেও কাজে লাগানো যায়।

সামুদ্রিক

  1. সামুদ্রিক মাছ শিকারে বাধানিষেধ
  2. সামুদ্রিক মাছ শিকার

মানুষ সেই আদিম কাল থেক তার উদর পূর্তির জন্য মাছ শিকার করে আসছে। অন্য ক্ষেত্রে মাছের প্রতিপালন ও চাষ করলেও লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য সামুদ্রিক মাছ শিকার করে। যুগ যুগ ধরে বিশাল এই জলাশয় থেকে মাছ আমরা ধরেই চলেছি। এই শিকার ও পরবর্তীতে তা গুদাম জাত করা, সদ্য সদ্য খাওয়া ছাড়াও সেগুলো সংরক্ষণ ও বাজার জাত করা ইত্যাদি কাজে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং এর ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিরাট ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

সামুদ্রিক মাছ শিকারে বাধানিষেধ




সামুদ্রিক মাছ শিকার করা হয়। আজ পর্যন্ত তাদের প্রতিপালন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এই বিশাল প্রাকৃতিক ভাণ্ডার থেকে মাছের জোগানে যাতে কোনও দিন ঘাটতি না পড়ে তার জন্য মানুষের হাতে এদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মাছের মোট জোগান যেখানে প্রতি বছর ১৬ লক্ষ তন, সেখানে সামুদ্রিক মাছের জোগান মাত্র ৩ লক্ষ টন। এবং এই জোগানও প্রতি বছর উত্তরোত্তর কমছে। যে হেতু আমরা সামুদ্রিক মাছ প্রতিপালন বা সৃষ্টি করতে পারি না, তাই এই ঘাটতি কমানোর দাওয়াই হিসাবে এর ফলন বাড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আমদের দায়িত্ব অনেক। এই মাছের জোগান উত্তরোত্তর কমার বহু কারণ। কিন্তু যেগুলোর জন্য আমরা সরাসরি দায়ী, সেগুলো সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ---
  • (১) যথেচ্ছ মাছ শিকার --- আমরা ভবিষ্যতের কথা মনে না রেখে বিনা বিচারে সব মাছ ধরে নিই। এই প্রক্রিয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়। যে সব জাতের মাছ সমুদ্রে বসবাস করে, কিন্তু ডিম পাড়ার জন্য নদীতে আসে, তাদের ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত --- (১) নদীতে আসার পথে তাদের কোনও মতেই শিকার করা চলবে না; (২) ডিম ছাড়ার পরে সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার পথে ধরা যেতে পারে; (৩) ডিমওয়ালা মাছ ধরা অপরাধ; (৪) এই ধরনের মাছ ছোট অবস্থাতেও ধরা চলবে না, সমুদ্রে ফেরার পর এদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনচক্র চলতে দিতে হবে; (৫) ডিম পাড়ার জন্য মিঠে জলে নিয়ে আসার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং (৬) নদনদী যাতে দূষিত না হয়, অগভীর না হয়, পরিমাণমতো জল ও তার উপযুক্ত স্রোত যাতে বজায় থাকে তার জন্য আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। কারণ নদনদীর গভীরতা, জলস্রোত, জলের নির্মলতা ইত্যাদির উপর বহুলাংশে এদের নদীতে আসা নির্ভর করে। প্রয়োজনে আইন করে ডিমওয়ালা বা বাচ্চা মাছ এবং অসময়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে।
  • ২) সমুদ্র দূষণের হাত থেকে সমুদ্র বাঁচানো --– সমুদ্রকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর যথা সম্ভব চেষ্টা করতে হবে। উত্পাদিত সামুদ্রিক মাছের অধিকাংশই সমুদ্র থেকে ধরা হয়। নানা কারণে সমুদ্রের জলকে আমরা দূষিত করে থাকে যা মাছের বংশবিস্তার, বৃদ্ধি ও বসবাসে ব্যাঘাত ঘটায়। নানা ধরনের জলযান সমুদ্রে চলাচল করে। নানা ধরনের যন্ত্র সমুদ্রে কাজ করে। এ সবের বর্জ্য এবং স্থলভূমির বর্জ্যপদার্থ সমুদ্রের জল দূষিত করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সব বর্জ্য মাছের পক্ষে ক্ষতিকারক। এই দূষণ যতটা সম্ভব আমাদের বন্ধ করতে হবে।

সামুদ্রিক মাছ শিকার

জলের গভীরতার উপর ভিত্তি করে সাগরের মাছ শিকারকে দু’ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে —
  • (১) সমুদ্রোপকূলবর্তী : সাগরে মানুষ নানা উপায়ে মাছ শিকার করে থাকে। সাধারণ জাল দিয়ে মাছ ধরা থেকে শুরু করে নানা রকম বিশেষ ধরনের জাল বা দেশি বা উন্নত উপায়ে সমুদ্রের ৫ মিটার গভীরতাসম্পন্ন জলে মাছ ধরা এই ভাগের অন্তর্গত। যেমন – ম্যালেট, পার্চ ইত্যাদি।
  • (২) গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা : নানা উপায়ে মানুষ আরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আরও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। যেমন ম্যাক্রেল, শার্ক ইত্যাদি।
এ ছাড়াও হ্রদ বা মোহনায় মানুষ সাধারণ উপায়ে জীবনের কম ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে থাকে। এখানে সীমিত প্রজাতির ও অল্প পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়।

মাছের জলাশয়ের শ্রেণি বিভাগ

জলাশয়

সমুদ্র উপকূলবর্তী
সমুদ্র
ডিমারসাল(৫ মিটারের নীচে)
পেলাডিক্স(৫ মিটারের উপরে)
খাড়ি
ভেড়ি


নদী
হ্রদখালবিল
দিঘিপুকুরডোবা
প্রজনন পুকুর
ডিম ফোটানো পুকুর
আঁতুড় পুকুর
প্রতিপালন পুকুর

মাছের শ্রেণি বিভাগ

জলের গুণাগুণের ভিত্তিতে

  • ১) মিঠে জলের মাছ : এরা খাল বিল নদী পুকুর ও ডোবায় বসবাস ও বংশ বৃদ্ধি করে। আমরা আমাদের প্রয়োজনে যত মাছের চাষ করি সেগুলো সবই মিঠে জলের মাছের উদাহরণ। যেমন — রুই, কাতলা, শিঙি, মাগুর ইত্যাদি।
  • ২) নোনা জলের মাছ : সমুদ্রের জল নোনা। সমুদ্রে যত রকম মাছ জন্মায় ও বসবাস করে সেগুলো সবই নোনা জলের মাছ। আমরা এই মাছের চাষ করি না। আমরা যে সব সামুদ্রিক মাছ খাই তার সবটাই শিকার ও সংগ্রহ করা। যেমন পমফ্রেট, টুনা।
  • ৩)অর্ধ নোনা জলের মাছ : ভেটকি, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি অনেক মাছের প্রজাতি আছে যেগুলো হ্রদে বা মোহানায় বসবাস করে। এরা অর্ধ নোনা জলের মাছ। এদের আমরা সাধারণত ভেড়িতে লাভজনক উপায়ে চাষ করে থাকি।
  • ৪) কিছু কিছু মাছ আছে যারা বসবাস করে সমুদ্র জলে। সেখানেই তাদের বাড় বাড়ন্ত। কিন্তু ডিম পাড়ার জন্য তাদের প্রয়োজন মিষ্টি জল। কিন্তু ছোট জলাশয় খাল বিল পুকুর ডোবায় এই কাজ সম্ভব নয়। এরা নদ-নদীতে দল বেঁধে আসে, জলের স্রোতের সঙ্গে তাল রেখে ডিম পাড়ার পর আবার দল বেঁধে ফিরে যায় সাগরের নোনা জলে। যেমন, ইলিশ মাছ।
  • ৫) কোনও কোনও মাছের চাষ অর্ধ নোনা বা মিষ্টি জলে হলেও তাদের প্রজনন ও ডিম দেওয়ার কাজ মিঠা জলে সাধারণ ভাবে এখনও হয় না। তাই ডিম বা ধানি পোনা নোনা জল থেকে সংগ্রহ করার পর তাদের চাষ করতে হয়। যেমন, ভেটকি, কাঁকড়া ইত্যাদি।
সাগর থেকে শুরু করে রঙিন মাছ পালনের জন্য ছোট ছোট ঘরের অ্যাকোয়ারিয়াম মাছের বসবাস প্রয়োজন ও বৃদ্ধির স্থান।

মাছের প্রয়োজনীয়তা

মাছ একটি প্রোটিন সমৃদ্ধ বা উত্কৃষ্ট আমিষ জাতীয় খাবার। বিশেষ করে যে মানুষেরা আমিষভোগী ও যাদের প্রধান খাদ্য ভাত তাদের কাছে খাদ্য হিসাবে খুব উপযোগী। মাছে শতকরা ১৫ – ২৫ ভাগ প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য। মানুষের প্রয়োজনীয় ও উত্কৃষ্ট মানের অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলির অধিকাংশই মাছ থেকে পাওয়া যায়। প্রোটিন ছাড়াও মানুষের দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে। মাছে প্রচুর প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন — ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশ ইত্যাদি পাওয়া যায়। মাছে বিদ্যমান ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ ভীষণ উত্কৃষ্ট মানের। এ ছাড়া সামুদ্রিক হাঙ্গর জাতীয় মাছের লিভার থেকে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ সমৃদ্ধ তেল পাওয়া যায়। যার দেশে-বিদেশে ভীষণ চাহিদা ও যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
বহু সামুদ্রিক মাছ আছে যেগুলি মানুষ খায় না। সেগুলি বিভিন্ন প্রকার কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন — (ক) এগুলোকে ছোট ছোট টুকরো করে গৃহপালিত মাংসাশী প্রাণীদের খাওয়ানো যেতে পারে। (খ) এগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে মাংসাশী প্রাণীদের খাবারের মান উত্কৃষ্ট করার জন্য মেশানো হয়। (গ) গাছের জন্য উত্কৃষ্ট মানের সার তৈরিতে এগুলি কাজে লাগানো হয়।
অনেক মাছের তেলে আলফা ‘লিনোলেনিক অ্যাসিড’ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রচুর পরিমাণে থাকে যেগুলো মানুষের শরীরে খুব প্রয়োজন। এইচ ডি এল এবং এল ইড এল অনুকূল মাত্রায় বজায় রাখে যা মানুষের নীরোগ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় সহায়ক।


মাছের কথা

মানুষ তার সৃষ্টির প্রথম থেকেই উদর পূর্তির জন্য লড়াই করে চলেছে। প্রথমে বনের ফল, মূল, পাতা, কাণ্ড, ফুল ইত্যাদি খেয়ে বাঁচত। পরে বনের পশু পাখি শিকার করত। তারও পরে আরম্ভ করে প্রকৃতির বিশাল জল সম্পদ (জলাশয়) থেকে মাছ শিকার করা। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই জল। এর বাইরে মানুষের প্রয়োজেন নানা জলাশয়ের সৃষ্টিও হয়েছে। বিশাল সমুদ্র থেকে শুরু করে নদ, নদী, খাল, বিল, পুকুর, ডোবার সৃষ্টি হয়। এগুলিতে যুগ যুগ ধরে মাছ অন্যান্য জলজ প্রাণীর সঙ্গে বংশ বিস্তার করতে থাকে। এ ছাড়া মানুষের প্রচেষ্টাতেও মাছ বিভিন্ন জলাশয়ে পাওয়া যায়। নিজেদের খাবারের জন্য এরা মাছচাষকে জীবিকা হিসাবে ব্যবহার করে। সমাজের বহু ও বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণীর বাঁচার তাগিদে সমস্ত জলাশয় থেকেই মাছ উত্পাদন করা ও ধরা হয়। তাই আমাদের জীবনে মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ও পণ্য। আর বাঙালির জীবনে তো কথাই নেই। কথায় বলে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। তাই মাছ সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা খুব দরকার।




মাছ কী ?

খুব সাধারণ ভাবে জলজ প্রাণী যেমন — রুই, কাতলা, মৃগেল থেকে পুঁটি, কৈ, মাগুর, মায়া ইত্যাদি নানা রকম ছোট বড়, আঁশওয়ালা বা আঁশহীন মাছ এবং কুঁচে, কাঁকড়া, চিংড়িংকেও মাছ বলে থাকি। এইগুলি সবই আমরা খাই। এগুলো প্রতিপালন, আহরণ, ব্যবসা ও নানা রকম জীবন জীবিকার কাজে লাগে। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় মাছ বলতে বোঝায় —

  • ১) ঠান্ডা রক্তের জলজ মেরুদণ্ডী প্রাণী।
  • ২) এদের মাথার দু’দিকে কানকো ঢাকা ফুলকা থাকে। এই ফুলকার সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ করে। জলের মধ্যস্থ জলে মিশে থাকা অক্সিজেন গ্রহণ করার ক্ষমতা এদের আছে। কারও কারও বাতাসে থাকা অক্সিজেন গ্রহণ করে অনেকক্ষণ বেঁচে থাকার ক্ষমতাও আছে।
  • ৩) এদের শরীরের মধ্যে বাতাসের থলি থাকে। এই থলির সাহায্যে এরা জলের মধ্যে ভেসে থাকতে পারে।
  • ৪) এদের শরীরের বাইরে অনেকগুলো পাখনা থাকে। পাখনাগুলোতে রশ্মির আকারে কাটা আছে। যেগুলো সারা জীবন থাকে এবং যার সাহায্যে নানা কাজ করে। যেমন — চলা ফেরা, সাঁতার কাটা, দিক পরিবর্তন, শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা ইত্যাদি। অতএব মাছের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা হল : মাছ একটি ঠান্ডা রক্তের, মেরুদণ্ডী প্রাণী যে ফুলকার সাহায্যে শ্বাস প্রশ্বাসের কাজ করে। পাখনার রশ্মির কাটা যা সারা জীবন থাকে। এর সাহায্যে চলাফেরা করে ও ভারসাম্য বজায় রাখে।

মাছ ও মাছ চাষের খুঁটিনাটি

রুই

রুই মাছ সাধারণত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে যেমন শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও এদের চাষের চেষ্টা চলছে। এদের দেহ লম্বা ও দ্বিপার্শ্বীয় ভাবে প্রতিসম ও দু’ পাশে চাপা থাকে, মাথাটি ছোট ত্রিকোনাকার এবং মুখের উপরের ঠোঁটে এক জোড়া শুঁড় থাকে। মাথা ও লেজের দিকে ক্রমশ সরু, অনেকটা মাকুর মতো। দেহের পাখনাগুলির বর্ণ লালচে রঙের কিন্তু পেটের দিকের রঙ হালকা সাদা। আবার মাথার সামনের দিক ও পিঠের দিকের রঙ কালচে হয়। রুই মাছ জলের মাঝামাঝি অংশে বিচরণ করে। ছোট অবস্থায় জুপ্ল্যাঙ্কটন বা প্রাণীকণা খায়। বড় হলে এরা উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, জলজ উদ্ভিদের নরম পাতা খায়। রুই মাছের দু’ বছর বয়সেই জননক্ষমতা হয়। এই সময় পরিণত ডিম্বাশয়ে মোট ২.২৬ লক্ষ থেকে ২.৮ লক্ষ ডিম সৃষ্টি করে। এরা বদ্ধ জলাশয়ে ডিম পাড়ে না। বর্ষাকালে স্রোতযুক্ত মিষ্টি জলে ও প্রজনন পদ্ধতিতে বদ্ধ জলাশয়ে ডিম পাড়ে। অনুকূল পরিবেশে এক বছরে ৯০০ গ্রাম ওজন হয়। এই মাছের বৃদ্ধি কাতলার থেকে একটু কম। ছোট অবস্থায় কাতলার দামের চেয়ে রুই মাছের দাম তুলনায় একটু বেশি। আবার ৩- ৪ কেজি ওজনের উপরে কাতলা মাছের চাহিদা বেশি। তাই রুই মাছকে ছোট থেকেই বিক্রি করা হয় প্রয়োজনমতো।

মৎস্য চাষ কাতলা

কাতলা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। ভারতের উত্তর ভাগের নদ-নদী, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, ও মায়ানমার প্রভৃতি দেশে এই মাছ পাওয়া যায়। কাতলা মাছের মাথা দেহের অনুপাতে বেশ বড়। দেহকাণ্ডটি দু’ পাশে চ্যাপ্টা। দেহের রঙ সাদাটে। তবে যে পুকুরে জলজ উদ্ভিদ বেশি ও শ্যাওলা থাকে সেখানে দেহের রঙ কালো হয়। মুখটি বড়, ঠোঁট ও শুঁড়হীন হয়। সমগ্র দেহটি আঁশ দিয়ে ঢাকা থাকে। এরা পুকুরের উপরের অংশে বিচরণ করে। ছোট অবস্থায় প্রাণীখাদ্য কণিকা খায়। মাছ বড় হলে প্রাণী খাদ্যকণা ছাড়াও উদ্ভিদকণা, শ্যাওলা ও খোলোসযুক্ত অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী খায়। বাজারে এদের ভীষণ চাহিদা। এদের যত বড় করা যায় চাহিদা এদের ততই বাড়ে। এবং তুলনামূলক ভাবে লাভ বেশি হয়। নিয়মিত খাবারের জোগানের সঙ্গে পুকুরের পরিচর্যা ও রোগ-পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারলে এই জাতীয় মাছ অনেক বড় হতে পারে। সাধারণ ভাবে ৫-১০ কেজি ৩ – ৭ বছরেই হতে পারে। স্থানীয় পুকুরে বড় করার প্রধান অন্তরায় সামাজিক ব্যধি। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনমতো কিছু কিছু করে ধরে বাজারে আনা যায়। দ্বিতীয় বছরেই এদের জননঅঙ্গ পরিপক্কতা লাভ করে। এক কেজি ওজনের মাছে ৭০,০০০ ডিম থাকে। এরা পুকুরে ডিম পাড়ে না, স্রোত যুক্ত জলে ডিম পাড়ে।


মৎস্য চাষ মৃগেল দেশি মাছ

মৃগেল মাছ ভারতের বিভিন্ন নদনদী ছাড়া বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মায়ানমারে পাওয়া যায়। এদের দেহ সরু, লম্বা ও মাথাটি ছোট। রুপোর ন্যায় সাদা আঁশে দেহ ঢাকা। এরা পুকুরের তলায় থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা খায়। বড় হলে শ্যাওলা, উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, জলজ উদ্ভিদ, পুকুরের তলদেশের ক্ষুদ্র ক্ষু্দ্র প্রাণী ও কাদামাটি খায়। এদের দেহের বৃদ্ধি কাতলা ও রুই মাছের তুলনায় কম। মৃগেল মাছ প্রথম অথবা দ্বিতীয় বছরে জননঅঙ্গের পরিপক্কতা লাভ করে। ১-১.৫ কেজি ওজনের মাছের ডিম্বাশয়ে ১.২৮ লক্ষ থেকে ১৯ লক্ষ ডিম পাওয়া সম্ভব। বর্ষাকালে নদীর পার্শ্ববর্তী নিম্ন অঞ্চলে যেখানে প্লাবিত হয় সে সব জায়গায় এরা ডিম ছাড়ে।
বাজারে মৃগেল মাছের চাহিদা রুই কাতলার তুলনায় একটু কম। কিন্তু পুকুরের তলদেশকে ভালো ভাবে কাজে লাগানোর জন্য এই মাছ চাষ খুব উপযোগী। এই মাছ অনেক ছোট অবস্থায় থেকে বাজারে আনা হয়। তাই অপেক্ষাকৃত একটু বেশি সংখ্যায় বাজারে আসার ফলে দামও অন্যান্য মাছের তুলনায় একটু কম হয়।