Saturday, 26 November 2016

অন্তর্দেশীয় জলাশয়

মিঠে জল





যে মাছকে বেশির ভাগ মানুষ তাদের খাদ্য হিসাবে বা তাদের জীবন ও জীবিকা হিসাবে ব্যবহার করে তার প্রায় ৪০ শতাংশ মিঠে জলের মাছ বা অন্তর্দেশীয় জলাশয়ে উত্পন্ন হয়। মাছশিকারিরা জীবনের কম ঝুঁকি নিয়ে এই সব মাছ ধরতে পারে। এদের মধ্যে কিছু কিছু মাছ ধরা হয় প্রাকৃতিক বড় জলাশয় থেকে। আর বাকি শিকার হয় মানুষের তৈরি করা ছোট জলাশয় থেকে। এই অন্তর্দেশীয় জলাশয়গুলিকে কয়েকটি শ্রেণি এবং উপ-শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেমন —
মিঠে জলাশয়গুলি জমানো বৃষ্টির জল, মাটির নীচের জল বা পাহাড় থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে সমৃদ্ধ। এই জলের মাছের জাতি-প্রজাতি ও গতিপ্রকৃতি নোনা জলের মাছের থেকে আলাদা। এ ধরনের জলাশয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন —
  • (ক) নদী : এই জলাশয় প্রাকৃতিক। প্রাকৃতিক উপায়ে এটি বৃষ্টির জল বা পাহাড়ের বরফ গলা জলে পরিপূর্ণ থাকে। নদনদীর গতিপ্রকৃতিও প্রাকৃতিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত। মানুষ এখানে মাছ চাষ করে না। প্রাকৃতিক কারণেই এখানে মাছের ডিম পাড়া, ডিম ফোটা থেকে আরম্ভ করে তাদের জীবনচক্রের সবটাই এখানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। মানুষের চেষ্টা ছাড়াই। মানুষ নানা উপায়ে নানা প্রয়োজনে এই মাছ ধরে খায় ও জীবন ও জীবিকার নানা কাজে লাগায়। রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, শাল, বোয়াল থেকে শুরু করে কৈ, মাগুর, চিংড়ি, বেলে, মৌরলা, বাটা এমনকী ইলিশ, চাঁদা ইত্যাদি মাছ এই জল থেকে মানুষ পেয়ে থাকে। অন্য ছোট জলাশয়ে প্রতিপালনের জন্য সদ্যোজাত ডিম, ধানি পোনাও এই নদনদী থেকে মেলে। নদনদী নিয়ম করে সংস্কার ও দূষণমুক্ত রাখা আমাদের কর্তব্য।
  • (খ) খাল, বিল (ক্যানেল, লেক ইত্যাদি ) : মানুষ চাষবাসের মতো অন্য কাজের সঙ্গে মাছ চাষের জন্যও এইগুলো প্রাথমিক ভাবে খনন করে থাকে। মূলত, কৃষির খেতে জল সেচের ব্যবস্থার জন্যই এদের উত্পত্তি। বছরে বারো মাসেই এগুলয়য় জল থাকে। তাই এগুলোতে প্রাকৃতিক আশীর্বাদের মতোই নিয়মিত মাছ চাষ হয়ে থাকে। ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সমবায় গঠন করেই এগুলো বেশি কাজে লাগানো হয়। এগুলোতে নামি-দামী মাছের সঙ্গে অনামি মাছও প্রচুর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হয়ে থাকে। এগুলো নিয়মিত ভাবে সংস্কার করা না হলেও মোটামুটি ভাবে পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত থাকে। এখানে রুই, কাতলা, মৃগেল থেকে মিষ্টি জলের সব মাছই চাষ হয়ে থাকে।
  • (গ) দিঘি-পুকুর-ডোবা: এগুলো ব্যক্তি-মালিকানাভিত্তিক। এগুলো মুখ্যত তৈরিই করা হয় গ্রাম সংলগ্ন অঞ্চলে মাছ চাষের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও সাংসারিক ছোটখাটো নানা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। এই সব জলাশয়ে নিজেদের খাওয়ার সঙ্গে ছোট বড় ব্যবসা করার জন্য অনিয়মিত বা বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছ চাষ করে হয়ে থাকে। এখানে মুখ্যত মাছ পালনই করা হয়।
  • এ ধরনের জলাশয়ের আবার নানা ভাগ থাকতে পারে --- প্রজনন (ব্রিডিং) পুকুর, ডিম ফোটানোর (হ্যাচারি) পুকুর, আঁতুড় (নার্সারি) পুকুর ও প্রতিপালন (রিয়ারিং) পুকুর। এগুলো বিশেষ যত্ন নিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি ও ব্যবহার করা হয়। এগুলো আকৃতিতে ছোট হয়। নিজেদের পছন্দের মাছের প্রজনন, তার থেকে ডিম সংগ্রহ, ডিম ফোটানো, ধানি পোনা ও ছোট পোনা এবং মাছ প্রতিপালনের জন্য তৈরি করা হয় এবং এই সব কাজের জন্য এখানে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এখানে সাধারণত ব্যবসাভিত্তিক এবং নামি-দামী মাছের পোনা উত্পন্ন করা হয়।
  • (ঘ) রঙিন মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম : এইগুলো কাচের ছোট বড় বাক্সের আকৃতির জলাশয়। নানা রকম, নানা ঢঙ, নানা কাঠামোর হয়ে থাকে এগুলো। এর ভিতরে রঙিন মাছ রাখা হয়। বাড়ির শোভা বৃদ্ধি বা কোনও স্থানকে বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য এগুলো স্থাপন করা হয় এবং এর ভিতর দৃষ্টিনন্দন নানা মাছ রেখে দেওয়া হয়।


সমুদ্র অঞ্চলে সমুদ্রের নোনা জল ও বৃষ্টির জল মিশে থাকে এই জলাশয়গুলোতে। এখানে নোনা জলের মাছই মুখ্যত থাকে কিন্তু সেখানে গভীর সমুদ্রের মাছ, খুব বড় মাছ বা অতি নোনা জলের মাছ থাকে না। সাধারণত দু’ রকমের অর্ধ নোনা জলাশয় দেখা যায় ---
  • (ক) খাড়ি : এগুলি সমুদ্র তীরবর্তী প্রাকৃতিক সৃষ্টি। সমুদ্রের কাছে নিচু জায়গা জোয়ারে প্লাবিত হয়। পরবর্তী কালে জোয়ারের জল সেখানে আবদ্ধ হয়ে একটা বিস্তীর্ণ জলাশয় সৃষ্টি করে। প্লাবন কালে যে সব মাছ জলের সঙ্গে আসে মুখ্যত সেগুলি শিকার করা হয়। সেখানে আলাদা করে কোনও মাছ চাষ করা হয় না।
  • (খ) ভেড়ি : সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকায় লবণাক্ত মাটিতে উপযুক্ত ফসল ফলানো কঠিন। অনেক সময় মানুষ সেই সব অঞ্চলে বড় বড় পুকুরের মতো জলাশয় তৈরি করে মাছ চাষ করে। এগুলো মাছ চাষের জ্ন্যই মুখ্যত তৈরি হয় এবং এখানে ব্যবসাভিত্তিক মাছ চাষ হয়ে থাকে। এগুলো বৃষ্টির জলে সমৃদ্ধ থাকে — প্রয়োজনে পাম্পের সাহায্যে জল দেওয়া হয়। এখানে ভেটকি, তেলাপিয়া, চিংড়ি চাষ লাভজনক। সমুদ্র থেকে বেশ দূরে নিচু ধানজমিকে অনেকে ভেড়িতে পরিণত করে মাছ চাষ করছে। সেখানে রুই, কাতলা, কৈ, মাগুরের চাষ করেও বেশ লাভ করা যায়। এখানে শুধু মাছ প্রতিপালন করা হয়। ভেড়িতে প্রজনন বা ডিম ফোটার কোনও ব্যবস্থা থাকে না। এ ছাড়াও ধান জমিতে মাছের চাষ হয়। নিচু জমিতে ধান চাষের সঙ্গে সঙ্গে চলে মাছের চাষ। নিচু জমিতে ধানের মধ্যে জল অনেক দিন থাকে। এই সময় এতে জিওল মাছের চাষ খুব ভালো হয়। ধানি পোনা থেকে চারা পোনা তৈরিতেও কাজে লাগানো যায়।

No comments:

Post a Comment