শাকাহারি থেকে সর্বভুক
অন্তর্দেশীয় জলাশয়গুলির জলকেই আমরা মিঠে জল বলে থাকি। ছোট অ্যাকুরিয়াম থেকে শুরু করে আঁতুড় পুকুর, খাল, বিল, নদ, নদী -- সবই মিঠে জলের আধার। তাই এই জলের জলাশয়গুলির রীতিমতো বৈচিত্র্য, ততোধিক বৈচিত্র্যময় মাছের প্রকারভেদ। আকৃতি-প্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, রঙ-ঢঙ, স্বাদে-গন্ধে তাদের বৈচিত্র্য সীমাহীন। তাদের চাষের পদ্ধতিও ভিন্ন। আমরা মিঠে জলেই মাছ চাষ করে থাকি। এখানে আমাদের পছন্দমতো মাছ উপযুক্ত জলাধারে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চাষ করতে পারি। তাই মাছের প্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকা দরকার।
খাদ্যের প্রকারের উপর ভিত্তি করে মাছকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
- (১) শাকাহারি : এই শ্রেণির মাছেরা জলের ছোট ছোট উদ্ভিদ, উদ্ভিদকণা, পচাগলা অংশ অথবা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন খেয়ে বেঁচে থাকে, বৃদ্ধি পায় ও বংশ বিস্তার করে। যেমন সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প।
- (২) মাংসাশী : মূলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী (জুপ্ল্যাঙ্কটন) থেকে শুরু করে জীবের দেহাংশ বা পচাগলা প্রাণীদেহই এদের পছন্দের এবং প্রধান খাবার। শিঙি, মাগুর, কৈ, ল্যাটা, ফলুই ইত্যাদি এই দলভুক্ত।
- (৩) রাক্ষুসে মাছ : এরা মাংসাশী। এরা বস্তুত মাংসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। জলজ প্রাণী, ছোট মাছ, মাছ-মাংসের টুকরো রাক্ষসের মতো খায়। এদের দৌরাত্মে পুকুরে বা জলাশয়ে অন্যান্য ছোট মাছের জীবন আশঙ্কিত ও অতিষ্ট হয়ে ওঠে। বোয়াল, চিতল, প্যাঙ্গাস, হাঙ্গর, তেলাপিয়া এই রাক্ষুসে মাছের উদাহরণ।
- ৪) সর্বভুক : এই জাতীয় মাছ বস্তুত সব রকম খাবারই খায়। এদের নিজস্ব পছন্দের খাবার পোকামাকড় হলেও এরা প্রয়োজনে উদ্ভিদজ খাবার খেয়ে থাকে। আবার যারা মূলত উদ্ভিদভোজী প্রয়োজনে তারা পোকামাকড় বা জুপ্ল্যাঙ্কটন খেয়ে থাকে। অধিকাংশ মাছই তাদের ছোট অবস্থায় জুপ্ল্যাঙ্কটন খেতে পছন্দ করে। পরে প্ল্যাঙ্কটন বা অন্য খাবার খায়। যেমন কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি।
চাষযোগ্য মাছেদের খাদ্য সংগ্রহের বিভিন্ন স্তর
সব মাছের যেমন একই রকম খাদ্য পছন্দ নয় তেমনই সব মাছই জলের একই স্তরে থাকে না। বহুল প্রচলিত চাষযোগ্য মাছগুলি জলের বিভিন্ন স্তরে থাকে এবং সেই অনুযায়ী খাবার সংগ্রহ করে।
আমরা আমাদের পুকুর, দিঘি, বিলে যখন সুনির্দিষ্ট মাছের চাষ করি তখন বাজারের কথা ভেবে এবং নিজের লাভের দিকে নজর রেখে সাধারণত রুই, কাতলা, মৃগেল, সাইপ্রিনাস কার্প, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মাগুর, শিঙি, কৈ, বাটা ইত্যাদি মাছের চাষ করে থাকি। জলাশয়ের জল, খাবার, জলস্থিত অন্যান্য মাছের প্রয়োজনীয় উপাদানের সুষ্ঠু বিবর্তনের জন্য মাছেদের এই অভ্যাস সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা প্রয়োজন। নদ-নদী, খাল, বিল, দিঘি, পুকুরের জলের তিনটি স্তর কল্পনা করা যেতে পারে।
- (১) উপরি স্তর : জলের সব থেকে উপরের স্তর, যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে ফলে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটন তাদের ক্লোরোফিলের সাহায্যে খাবার সংগ্রহ করে ও বংশ বিস্তার করে। এই স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণও বেশি। এখানে জলস্রোত বিদ্যমান। এ সব কাতলা মাছের খুব প্রয়োজন ও পছন্দের। কাতলা মাছ মুখ্যত এই স্তরেই থাকে। সিলভার কার্পও এই স্তরের বাসিন্দা।
- (২) মধ্যস্তর : এখানে জলস্রোত ও জল-তরঙ্গ অপেক্ষাকৃত কম। মাছের জন্য জুপ্ল্যাঙ্কটন, প্ল্যাঙ্কটন ও অক্সিজেন উপযুক্ত পরিমাণে থাকে। এই স্তরের বাসিন্দা রুই মাছ, গ্রাস কার্প, বাটা মাছ ইত্যাদি।
- (৩) নিম্নস্তর : জলাশয়ের নিম্ন স্তরে প্ল্যাঙ্কটনের চেয়ে জুপ্ল্যাঙ্কটনই বেশি থাকে। জলজ ক্ষুদ্র প্রাণীও বেশি থাকে এই স্তরে। এখানে জলের স্রোত প্রায় নিস্তেজ। এখানে পাঁকমাটি যথেষ্ট থাকে। এই স্তরে মৃগেল, শিঙি, মাগুর, কৈ, ল্যাটা, শোল, শাল ইত্যাদি মাছের বসবাস।
No comments:
Post a Comment